স্টাফ রিপোর্টার:
৫ আগষ্ট পুর্ববর্তী আওয়ামী দুঃশাসনকালে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ছিলো দালালদের রমরমা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখানে গড়ে প্রস্তুতকৃত ১০০ টি পাসপোর্টের মধ্যে অন্তত ৯০ টি পাসপোর্ট তৈরি হতো দালালদের গোপন সংকেতের ভিত্তিতে। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ গোপন সংকেতের ভিত্তিতে পাসপোর্টের সিস্টেম চালু করেছিলো পাসপোর্ট অফিসের সামনের কম্পিউটার দোকান গুলো। কম্পিউটার দোকানে আবেদন করতে গেলে তারা বলতো যে নিজে নিজে করবেন নাকি আমাদের মাধ্যমে করবেন, আমাদের মাধ্যমে করলে কোন ঝামেলা ছাড়া হয়ে যাবে এবং পুলিশ ভেরিফিকেশনে কোন সমস্যা হবেনা । তখন মানুষজন হয়রানির ভয়ে কম্পিউটার দোকানদারকে নির্দিষ্ট ফি ব্যতীত বাড়তি আরো তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট করাতে হতো। এভাবে সেবা প্রত্যাশীদের হয়রানির ভয় দেখিয়ে সিস্টেমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতো দালাল চক্র। কম্পিউটার দোকান ছাড়াও কিছু আনসার সদস্য ও ভাসমান দালালরা এ কাজে জড়িত ছিলো৷ কারো আবেদনে কোন ক্রুটির কারনে পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করা কর্মকর্তারা পুনরায় আবেদন সংশোধন করে নিয়ে আসতে বললে তারা এ সুযোগটা কাজে লাগাতো। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসৎ কর্মকর্তারা আবেদনকারীদের ছোটখাটো ভুলের কারণে আবেদন বাতিল করে দিয়ে পুনরায় আবেদন করে নিয়ে আসতে বলতেন। মুলত তাদের উদ্দেশ্য থাকতো যাতে সেবা প্রত্যাশীরা দালালদের শরণাপন্ন হতে হয়।
তবে ৫ আগষ্টের ছাত্র-জনতা অভ্যূত্থানের পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে কেমন চলছে নোয়াখালীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম তা দেখতে সরেজমিনে অনুসন্ধান চালায় কালবেলার নোয়াখালী ব্যুরো টিম।
পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করতেই দেখা হয় আরিফ নামের এক যুবকের সঙ্গে, সে পাসপোর্ট নিতে এসে জানতে পারে তার পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট জমা হয়নি। পাসপোর্ট অফিস পুলিশের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেয়। তার বাড়ি নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায়। পাসপোর্ট অফিস থেকে যার দুরত্ব প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার। এবং যাতায়াতের একমাত্র পথ হলো নৌযান। জিজ্ঞেস করা হলে সে বলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাকে কোন কল বা ম্যাসেজ দেওয়া হয়নি।
পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রুমের সামনে যায় কালবেলা টিম৷ সেখানে অন্তত ১৫ জনের সাথে কথা হয়। তারা সবাই জানায় তারা আবেদন নিজে করে নিজে নিজে জমা দিয়েছেন। কোন ধরনের হয়রানির শিকার হননি৷ তারমধ্যে শিহাব নামে একজন সেবা প্রত্যাশী বলেন, কম্পিউটার দোকানে আবেদন করতে গেলে সে আমাকে বলে নিজে নিজে আবেদন করলে অনেক হয়রানি হতে হয় আপনি আমাদের মাধ্যমে করাতে পারেন। কিন্তু আমি তাদের ফাঁদে পা দেয়নি। নিজের আবেদন নিজেই জমা দিয়েছি কোন হয়রানি হতে হয়নি। এই ১৫ জনের মধ্যে কথা হয় ওমান গমনেচ্ছু সুজন নামের এক যুবকের সাথে, সে জানায় তার ভাইয়ের মাধ্যমে কম্পিউটার দোকান থেকে আবেদন করাই ছিলো। কম্পিউটার দোকানদার হয়রানির ভয় দেখিয়ে ভুল বুঝিয়ে বাড়তি তিন হাজার টাকা নিয়ে গেছেন। তারপরও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে পেরে সে খুশি। ঘুষ নেওয়া কম্পিউটার দোকানের পরিচয় জানতে চাইলে সে বলতে রাজি হয়নি৷
এছাড়াও আইইএলটিএস পড়া ইউরোপ গমনেচ্ছু সুমন নামের এক শিক্ষার্থীর সাথে কয় হয় সে জানায় প্রাথমিক আবেদন জমা দিলে সেখানে এনআইডির ফেরিফিকেশন কপিতে নির্বাচন কর্মকর্তার সিল সাইন না থাকায় পুনরায় সংশোধন করে নিয়ে আসতে বলা হয়৷ আমি সংশোধন করে নিয়ে আসছি এখন আবেদন পত্র জমা দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পন্ন করেছি। তবে প্রস্তুত হওয়া নতুন পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া কয়েকজন সেবা প্রত্যাশীর সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের কাউকে পুলিশের ডিএসবি শাখা থেকে কল বা ম্যাসেজ দেওয়া হয়নি৷ তারা অনেকে নিজ থেকে ডিএসবি অফিসে যোগাযোগ করেছেন আবার অনেকে পাসপোর্ট নিতে এসে জানতে পারেন পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়নি তখন ডিএসবি অফিসে যোগাযোগ করে পুলিশ ভেরিফিকেশন করে নিয়েছেন।
সেবা প্রত্যাশী, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা, স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে এবং সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে ৫ আগষ্ট পরবর্তী নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য এবং অবৈধভাবে টাকা লেনদেন অনেক কমে গিয়েছে৷ তবে কম্পিউটার দোকান গুলো পাসপোর্ট অফিস সম্পর্কে মানুষের পুর্বের ভীতি ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবং পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানির কথা বলে হয়রানি মুক্ত ভাবে পাসপোর্ট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কারো কারো থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এসব বিষয়ে কালবেলার সাথে কথা বলেন,
নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক নাহিদ নেওয়াজ। তিনি বলেন, আমি শুনেছি আগে এ অফিসে ১০০ টি পাসপোর্ট হলে ৯০ টি পাসপোর্ট হতো রাজনৈতিক সিন্ডিকেট ও দালালদের মাধ্যমে। আমি যোগদান করেছি মাত্র দুই মাস হলো। আমি আসার পর আমার অফিসকে দুর্নীতি ও হয়রানি মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছি। আমার কোন কর্মকর্তা, স্টাফ বা আনসার সদস্য যদি ঘুষ নেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর শুনেছি অনেক অসাধু কম্পিউটার দোকানদাররা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বাড়তি টাকা নেয়, কোন সেবা প্রত্যাশী যদি স্পেসিফিক ভাবে কোন দোকানদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রদান করে তাহলে প্রশাসনের কাছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবো। আমরা আন্তরিক ভাবে সেবা দিতে সব সময় প্রস্তুত রয়েছি। তবে লোকবল সংকট এবং লজিস্টিক সাপোর্ট কম থাকায় মাঝেমাঝে সেবা ধীরগতিতে হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানির বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন এটা তো আমার অফিস সংশ্লিষ্ট না৷ এটা পুলিশের বিষয়, তারপরও আপনারা যেহেতু বলেছেন আমি পুলিশ প্রশাসনের সাথে কথা বলবো।